Wednesday, July 1, 2015

চাকমা জাতির সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ





বাঙ্গালির পরে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগৌষ্ঠী হচ্ছে চাকমা। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে চাকমারাই প্রধান জনগৌষ্ঠী। চাকমারা নিজেদেরকে "চাঙমা" নামে অভিহিত করে। নৃবিজ্ঞানীদের মতে, এ এলাকার অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মত চাকমারাও মঙ্গোলীয় বংশদ্ভুত। বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় চাকমারা বসবাস করে। এছাড়া ভারতের মেঘালয়,আসাম ত্রিপরা, অরুনাচল ও মিজোরাম রাজ্যে এবং মায়ানমারে কিছুসংখ্যক চাকমা বসবাস করে। ১৯৯১ সালে আদমশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে চাকমাদের জনসংখ্যা ২,৩৯,৪১৭ জন হলেও বর্তমানে তিন লক্ষের অধিক বলে জানা গেছে।
ইতিহাসঃ
চাকমা জাতির আদি উৎপত্তিকাল, আবাসস্থল সম্পর্কে সঠিক ইতিহাস কিংবা প্রামান্যচিত্র পাওয়া না গেলেও বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে আগমন ও স্থাপনের ইতিহাসের কাহিনী অতি প্রাচীন কালের বলা যায়। কেননা তার ইতিহাস উল্লেখ করে দেখা গেছে ষোড়শ শতাব্দির মধ্যে ভাগে একজন বিখ্যাত পর্তুগীজ ইতিহাসবিদ কতৃক বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলো নিয়ে আঁকা মানচিত্রে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীরবর্তী দুইটি নদীর মধ্যে ভাগে 'চাকোমাস' নামের একটি রাজ্যর অস্তিত্ব খুজে পাওয়া গেছে। ধারণা করা যায়, কর্ণফূলী নদীর তীর থেকে মাতামুহুরি নদীর উল্টার তীর পর্যন্ত এই চাকোমাস রাজ্যটির অবস্থান ছিল। এর যটেষ্ট প্রমাণ মিলে কক্সবাজার জেলার থেকে ৬ মাইল পূর্বে এবং রামু বাজার থেকে দুই মাইল পশ্চিমে এখনও চাকমাকুল নামের একটি ইউনিয়ন বিদ্যমান রয়েছে। আর এ থেকে ধারণা করা যায়, চাকমারা এক সময় রামু পর্যন্ত বসবাস স্থাপন করেছিল। এই সময় চাকমা রাজ্যর রাজধানী হিসেবে তৈন বা অলেখ্যং ডং ছিল বলে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে জানা গেছে। বর্তমানে বান্দরবানের আলিকদমকে সে সময় বলা হতো আলেখ্যং ডং। বান্দরবান জেলার তৈন নামের একটি মৌজা এখনো রয়েছে। এছাড়া কালের বিবর্তনে এবং ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় চাকমা রাজতন্ত্রের উত্থান পতন, যুদ্ধ, সংঘাত নানা চড়াই উৎরাইয়ের ফলে চাকমাদের আবাসস্থল ও বিভিন্ন রাজধানী স্থাপনের কথা জানা যায়। বার্মা ও মোগলদের সাথে যুদ্ধ সংঘাত এবং এবং সম্পর্কে এ আবাসস্থল শঙ্খনদীর তীরবর্তী হাঙ্গরকুল সহ চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উল্টের পূর্বদিকের পার্বত্য মধ্যবর্তী এবং উত্তরাঞ্চলে তথা রাঙ্গামাটি বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় স্থানান্তর হয়ে সেখানে স্থায়ীভাবে বনসবাস করতে থাকে যা বর্তমান পর্যন্ত বিদ্যমান।
সামাজিক বৈশিষ্ট্যঃ
চাকমাদের সামাজিক বৈশিষ্ট্য চাকমারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। এরা অনেক গৌষ্ঠীতে বিভক্ত। এ পর্যন্ত ৪০ টি গৌষ্টির কথা জানা গেছে। এদের পরিবার পিতৃপ্রধান। চাকমা জনগৌষ্টির প্রধান হচ্ছেন রাজা। যে কোনো ব্যাপারে রাজার মতামত চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। চাকমাদের কিছু ভালো গুণাগুণ রয়েছে। তারা বিপদে-আপদে এবং অভাবের সময় একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতা করে। চাকমাদের সমাজ নানা বৈশিষ্ট্যে পূরিপূর্ণ।
গৃহ ও বাসস্থানঃ
চাকমারা গ্রামকে আদাম এবং গ্রামের প্রধানকে কার্বারী বলে। ছোট ছোট নদীর তীরে অথবা কম উঁচু পাহাড়ের ওপর খোলামেলা জায়গায় গ্রামগুলো অবস্থিত। শক্ত গাছের ওপর কাঠ ও বাঁশ দিয়ে মাছাঘর বানায়। মাচাঘরের ওঠার জন্য সিঁড়ি থাকে। মাচাঘরের সামনে জলের পাত্র রাখার জন্য একটি খোলা ছোট মাচা থাকে। একে 'ইজর' বলে।
খাদ্যভাসঃ
চাকমাদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে ভাত ও মাছ। তারা ভাতের সাথে মাছ, মাংস ও শাকসবজি খেতে ভালোবাসে। শুটকি মাছ খেতে এরা খুব পছন্দ করে।
পোশাকঃ
চাকমারা নিজেদের তাঁতে কাপড় বোনে। এই কাপড় দিয়ে তারা পোশাক তৈরি করে। এই পোশাকে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যর ছাপ আছে। চাকমা পুরুষরা লুঙ্গি, ধূতি শার্ট ও গেঞ্জি পরে। মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের নাম পিনোন-খাদি। কিশোরেরা নানা রকমম পোশাক পরে। এখন আধুনিক পোশাক পরনেও চাকমারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
পেশাঃ
চাকমারা জুম পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে। পাহাড়ের ঢালু জায়গায় গাছপালা গর্ত করে বীজ বপন করে। একে 'জুম চাষ' বলে। সমতল ভূমিতে তারা লাঙ্গল দিয়ে হালচাষ করে বিভিন্ন ফসল ফলায়। চাকমারা পোশাক তৈরি করে। দেশি-বিদেশীদের কাছে তাদেল তৈরি পোশাকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এরা হস্তশিল্প কাজেও দক্ষ। বর্তমানে অধিকাংশ চাকমা জনগৌষ্ঠী উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে এবং সরকারের সব ক্ষেত্রে অত্যান্ত দক্ষতার সাথে কাজ করে সুনাম অর্জন করছে।

ধর্মঃ
চাকমারা আদিকাল থেকেই বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। প্রায় সব চাকমা গ্রামে বৌদ্ধমন্দির আছে। এরা বৌদ্ধমন্দিরকে 'ক্যাং' বলে। বৌদ্দধর্মের বিভিন্ন পূজা-অর্চনা চাকমারা করে থাকে।


সংস্কৃতিঃ
চাকমাদের নিজস্ব ভাষা এবং বর্ণমালা আছে। তাদের নিজস্ব নাচ,গান এবং সাহিত্য ও ঐতিহ্য আছে। রুপকথা, পুরাকাহিনী ও সংস্কৃতিতে তারা পূরিপূর্ণ জাতি। নাদের খেলা, কুস্তি ও ঘিলা খেলা তাদের খুব প্রিয়। মেয়েরা বউচি খেলতে ভালোবাসে।
সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানঃ
চাকমারা বিভিন্ন সামাজিক উৎসব পালন করে থাকে। চাকমাদের শ্রেষ্ঠ উৎসবের নাম বিঝু উৎসব। বাংলা বছরের শেষ দুদিন ও নববর্ষের প্রথম দিন এ উৎসব পালন করা হয়। বিয়ে ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে এরা নাচ-গান করে। এছাড়াও চাকমাদের অনেক আচার অনুষ্ঠান রয়েছে। জন্মের পর শিশুর মুখে মধু দেওয়া হয় ।সাতদিন পর ওঝা ডেকে এনে শিশুর নাম রাখা হয়। চাকমাদের বিবাহরীতি খুব চমৎকার। বরযাত্রিরা কনের বাড়ি পৌঁছলে সাদরে গ্রহন করা হয়। মেয়েকে বরের বাড়িতে এনে চুঙ্গুলাং পূজা শেষে অনুষ্ঠান শেষ করা হয়। কেউ মারা গেলে মৃতদেহকে স্নান করানো হয়। তারপর সাদআ কাপড় পরিয়ে দাহ করা হয় ।

No comments:

Post a Comment